দেশে এক বছরের মতো তৃতীয় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। প্রতি মাসে মাসে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের যে নীতি নেয়া হয়েছে, তারই আওতায় দুই মাসের মধ্যে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাড়তি দাম দেয়ার পরেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে কি-না; তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন দেশবাসী।
রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা সোমা সাহা বলছেন, ‘সব জিনিসের মধ্যে বিদ্যুতের দাম আবার বাড়িয়েছে সরকার। সংসারের খরচ তো বাড়বেই, দেখা যাবে বাজারে জিনিসপত্রের দামও আরেকবার বেড়েছে। কিন্তু তারপরেও শান্তি পেতাম, যদি বিদ্যুৎ ঠিক মতো থাকে। গত বছর গরমের সময় তো অনেক কষ্ট পেয়েছি। এবার কি ঠিক মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে?’
তার মতো আশঙ্কা রয়েছে বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং বিশ্লেষকদের মধ্যেও। পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতউল্লাহ বলেছেন, ‘গরমের সময় লোডশেডিং এবারও হবে। তার কারণ হলো, এটার পেছনে যেসব প্রধান সমস্যা, তা তো দূর হয়নি। জ্বালানি সংকট তো থেকেই যাচ্ছে।’
‘আমাদের দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ক্রাইসিস আছে। এলএনজি বা এলপিজি দাম অনেক চড়া। কয়লা যদি কিনতে হয়, অনেক টাকা, সেটাও নেই। তেলের দামও চড়া, সেখানেও পয়সা নাই, ডলারের দামও বেশি। এসব মিলে আর বিতরণ ব্যবস্থা মিলিয়ে আমার মনে হয়, এবার গরমে তীব্র সংকট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা আছে,’- তিনি বলছেন।
তার মতে, ‘অনেক সংকট। কিন্তু এসবের সমাধান খুব কঠিন।’
তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেছেন, ‘সবমিলিয়ে গত বছরের পরিস্থিতি কিন্তু এখন নেই। পরিস্থিতি অনেক ভালো হয়েছে এবং আমরা এতোটুকু বলতে পারি, গত বছরের পরিস্থিতি তৈরি হবে না। গ্রাহকদের একটা স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারবো, আমরা এইভাবে এগোচ্ছি।’
উৎপাদন নিয়ে জটিলতা বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বাংলাদেশের এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। সেই সঙ্গে আমদানি হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। এ বছর গ্রীষ্ম, রমজান এবং সেচের চাহিদা হিসাব করে কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ১৬ হাজার মেগাওয়াট।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কেন্দ্র রয়েছে ১৫৪টি, যার মধ্যে বেশিরভাগই ভাড়ায় চালিত ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়া আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে গত বছর তীব্র চাহিদার সময়েও ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হয়। ফলে বেশ কয়েক বছর পর সারাদেশের বাসিন্দারা তীব্র লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হন। এমনকি শীতের সময়েও দেশের অনেক স্থানে লোডশেডিং করতে হয়েছে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সেই অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন না হওয়ায় এবারও একই রকম চিত্র দেখা যেতে পারে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেছেন, ‘বিদ্যুতের স্বাভাবিক সরবরাহ নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। ডলারের সিচুয়েশনটা তো এখনো ঠিক হয়নি। হয়তো কিছুটা ইম্প্রুভ করেছে। কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হয়নি।’
‘এ কারণে আমরা তো পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছি না। জ্বালানি কিনতে হলে যতটা ডলার লাগবে, সেই ডলার তো তারা দিতে পারবে না। না দিতে পারলে সমস্যা থাকবেই এবং লোডশেডিংও করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প আমি দেখছি না,’ -বলছেন অধ্যাপক ইজাজ হোসেন।
বিশ্লেষকরা আরও আশঙ্কা করছেন, এই বছরেও ডিজেল সাশ্রয় করতে গিয়ে ডিজেল নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়া গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও ঠিক মতো গ্যাস দেয়া যাচ্ছে না।
তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেছেন, ‘এই চাহিদা মাথায় রেখে আমরা আমাদের উৎপাদন পরিকল্পনা সাজিয়েছি। যেখানে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট গ্যাস থেকে পাওয়া যাবে, পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল থেকে আর সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট কয়লা থেকে আসবে। এছাড়া কিছু সোলার আর হাইড্রোপাওয়ার আছে। ডিজেলটা আমরা স্ট্যান্ডবাই হিসেবে রাখতে চাই।’
কয়লার বিদ্যুৎ এ বছর থেকে বাংলাদেশের বড় দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ আসতে শুরু করেছে। এই দুটি কেন্দ্র মিলিয়ে মোট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ২৬০০ মেগাওয়াটের বেশি। ডিজেল বা গ্যাস চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে না পারলেও বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এসব কেন্দ্রের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি ও এসব কেন্দ্রের উৎপাদন অব্যাহত রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ডলার সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় কয়লা আমদানি না হওয়ায় বাংলাদেশের অন্যতম বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপালে জানুয়ারি মাসে উৎপাদন একমাস বন্ধ রাখা হয়। জুন মাস থেকে রামপালের দ্বিতীয় ইউনিটের পুরো দমে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এই কেন্দ্রের দুটি ইউনিট চালু রাখতে যে পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন রয়েছে, সেটার সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে কি-না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন কেন্দ্রটির কর্মকর্তারাই।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) উপ-মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত না, কতদিন আমরা উৎপাদন করতে পারবো। চেষ্টা থাকবে কয়লার সরবরাহ যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে। যতদিন পর্যন্ত কয়লার সরবরাহ থাকবে, ততদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। নাহলে বন্ধ থাকবে। দেখা যাক কী হয়!’
আরেকটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা ২০২০ সাল থেকে যে পরিমাণ কয়লা আমদানি করেছে, তার মধ্যে সর্বশেষ জানুয়ারি মাস পর্যন্ত চীনের কোম্পানির কাছে অনাদায়ী বকেয়া পড়েছে প্রায় সাত কোটি ডলার। সংস্থাটি জানিয়েছে, বকেয়া পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তারা নতুন করে কয়লা আমদানিতে অর্থায়ন করবে না।
এসব জটিলতায় এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ওই কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি বন্ধ রয়েছে। নতুন কয়লা আমদানি করা না গেলে সেটিরও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। কয়লা কিনতে ডলারের বরাদ্দ চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু কাঁচামাল নিয়ে এরকম টানাপড়েনে উৎপাদন কতদিন স্বাভাবিক রাখা যাবে, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন কর্মকর্তারা।
অবশ্য পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানিয়েছেন, কয়লা সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যেই রামপালে কয়লা চলে এসেছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দুই বছর বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় যে কয়লা ব্যবহার করা হবে, সেটা আমদানি করতে ব্যয় হবে অন্তত পাঁচ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়াতে বিকল্প কিছু কি রয়েছে?
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পর্যবেক্ষক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেছেন, ‘সোলার পাওয়ার বা বাড়তি আমদানি করার মতো বিকল্প হয়তো থাকতে পারতো, কিন্তু সেটাও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এ একবছরের মধ্যে চাইলেই সেসব পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারলে বা কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে না পারলে লোডশেডিং করে সামাল দেয়া ছাড়া আর তো উপায় নেই। হয়তো এবারও আমাদের গতবছরের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।’
তবে বাংলাদেশ পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলছেন, ‘গত বছর ফুয়েলের যে দাম ছিল, সেটা কিন্তু এ বছর কমে এসেছে। ডলারের যে ক্রাইসিস ছিল, সেই পরিস্থিতির কিন্তু অনেক উন্নতি হয়েছে। সেই সঙ্গে আমরা যে পরিকল্পনা করেছি, সেটা নিয়ে নীতি নির্ধারক মহলের সঙ্গে কথা বলেছি। সংশ্লিষ্ট যে মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেখানেও কথা বলেছি। যেমন গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা এবং বিপিসি তারা আশ্বস্ত করেছে। কয়লা কেনার জন্য যে ফরেন এক্সচেঞ্জের দরকার হবে, সেটার জন্য শুধু আশ্বাস না, কয়লা আসাও শুরু হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, ‘সবমিলিয়ে আসলে গতবছরের অবস্থা এখন নেই। পরিস্থিতির অনেক ভালো হয়েছে। আমরা এটুকু বলতে পারি, গতবছরের পরিস্থিতি এবার রিপিট করবে না।’
আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ আমদানি এ বছরের গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এখন বাংলাদেশের বড় একটি আশার জায়গা ভারতের ঝাড়খণ্ডে তৈরি করা আদানি পাওয়ারের দিকে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন, এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে গোড্ডার ১৬০০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে প্রায় ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসতে পারে। দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আসবে পরের মাসে। তবে এর আগেও আরও তিন দফা বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হলেও সেটি কার্যকর করা যায়নি।
ভারত সরকারের একটি সূত্র বিবিসি-কে জানিয়েছে, দুই দেশ মিলিয়ে এই যে মোট ১৩৪ কিলোমিটার লম্বা ট্রান্সমিশন লাইন – সেটার কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি বলেই বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা দেরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি এটাও বলা হচ্ছে, এই কাজ বেশি বাকি আছে বাংলাদেশ অংশেই।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতউল্লাহ বলছেন, ‘সঞ্চালন ব্যবস্থা আপগ্রেড করার জন্য তো তারা (বাংলাদেশের কর্মকর্তারা) অনেক চেষ্টা করছে। যেসব কেন্দ্র থেকে বিতরণ লাইন গেছে, সেখানে সমস্যা আছে, ঢাকায় আছে, সারাদেশেই সমস্যাটা আছে। সেটা আপগ্রেড করার জন্য তারা চেষ্টা করছে। কিন্তু পুরোপুরি করা যায়নি। সেই সমস্যা গতবছরেও ছিল, এ বছরেরও আছে।’
তবে বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক মোঃ ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, ‘গ্রিড লাইন তৈরির কাজ আমরা সম্পন্ন করে রেখেছি। সারাদেশেই গ্রিড লাইন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ যোগ করা হলে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২৭০০ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশের বড় আরেকটি প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার আশাবাদের কথা জানানো হলেও সেখানকার সঞ্চালন লাইনের কাজ এখনো পুরোপুরি শুরুই হয়নি। ফলে ২০২৫ সালের আগে সেই বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা দেখছেন না কর্মকর্তারা। সূত্র: বিবিসি
Leave a Reply