ভারতের ব্যবসায়ীদের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দরের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। ১৩ বছর পর উভয় দেশের মধ্যে বন্দর সংক্রান্ত বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়েছে। ১৬টি রুটের মাধ্যমে ভারত থেকে পণ্য আসবে এই দুই বন্দরে। চারটি স্থলবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এ চারটি স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের পণ্য আনা নেওয়া হবে। এগুলো হলো সিলেটের তামাবিল-ডাউকি ও শেওলা-সুতারকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া-আগরতলা এবং কুমিল্লার বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর।
বাংলাদেশের দুটি সমুদ্র বন্দর ভারত ব্যবহার করলে উভয় দেশই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। এই দুই বন্দর ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্য ছাড়াও কাস্টমস ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট ফি আদায় করবে। এতে দেশের অর্থনীতিতে আসবে সমৃদ্ধি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, ভারত বাংলাদেশের বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আনা-নেওয়া করবে তাতে প্রতি চালানে ৩০ টাকা প্রসেসিং ফি, টনপ্রতি ২০ টাকা ট্রান্সশিপমেন্ট ফি, ১০০ টাকা সিকিউরিটি চার্জ ও ১০০ টাকা প্রশাসনিক চার্জ দেবে। এছাড়া কনটেইনার বা লরিপ্রতি কিলোমিটারে ৮৫ টাকা পুলিশ এসকর্ট ফি এবং প্রতিটি কনটেইনার স্ক্যানিং ফি ধার্য করা হয়েছে ২৫৪ টাকা। ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ এই ফি দিতে হবে। এর সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে সড়ক ব্যবহারের মাশুল দিতে হবে ১ টাকা ৮৫ পয়সা।
ব্যবসায়ীরা জানান, ট্রানজিট বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম বন্দর এ অঞ্চলের রিজিওনাল হাবে রূপান্তরিত হবে। বদলে যাবে চট্টগ্রাম বন্দর, পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতিও। সিঙ্গাপুরের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সমুদ্র পথে সরাসরি যোগাযোগের পথ উন্মোচন হয়ে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয় দ্বিগুণ হবে। ভারতের সেভেনসিস্টার বলে খ্যাত রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি, পারস্পরিক সম্পর্ক বহুলাংশে বেড়ে যাবে। কমে যাবে অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণও।
বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের এমডি তরফদার রুহুল আমিন বলেন, এটি আসলে আরো আগে হওয়া দরকার ছিল। ভারত বাংলাদেশের দুটি সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। উভয় দেশের ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবেন। বাংলাদেশ যেমন নতুন বাজার পাবে তেমনি ভারতের অনেক রাজ্য তাদের পণ্য কম খরচে বিদেশে পাঠাতে পারবেন। ইউরোপ ও আমেরিকা তাদের নাগালের মধ্যে চলে আসবে। বিশেষ করে ভারতের সেভেনসিস্টার রাজ্যগুলোতে অর্থনৈতিক গতি আসবে। বন্দর কতটুকু প্রস্ততÑ এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বন্দর এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। অত্যাধুনিক ইক্যুইপমেন্ট হ্যান্ডলিং চলছে। কনটেইনার রাখতে যাতে কোনো সমস্যা না হয় তার জন্য নানা অবকাঠামোও তৈরি করা হয়েছে।
সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোর মতো চট্টগ্রাম বন্দরকে ২১ শতকের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। ট্রানজিটের ফলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক হবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এসব রাজ্যের সঙ্গে মিয়ানমার, ভুটান ও চীনের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। এসব অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হলে সব দেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন।
ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে ভারতের সেভেনসিস্টার অঞ্চলগুলোর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশ না ঘটার কারণ একমাত্র সমুদ্র বন্দরজনিত। এসব রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য কলকাতা বন্দরকেন্দ্রিক। এ অঞ্চলে কোনো সমুদ্র বন্দর না থাকায় দূর পথ দিয়ে বিপুল খরচে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি-রপ্তানি করে থাকেন। অথচ কাছেই রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কলম্বোতে কনটেইনার জাহাজ চলাচল করছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাজারগুলো কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে ফিডার জাহাজে করে তাদের পণ্য বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে। এতে সময় ও ব্যয় দুটোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে এসব রাজ্যের ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি-রপ্তানি করলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং বাংলাদেশও অর্থনৈতিক লাভবান হবে।
কী আছে ভারতের সেভেনসিস্টার রাজ্যগুলোতে : অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের পরবর্তী দরজা বলে পরিচিত ভারতের সেভেনসিস্টার রাজ্যের অন্যতম অরুনাচল। প্রায় ৮৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের এ রাজ্যের উৎপাদিত প্রধান ফসল হচ্ছে ধান, ভুট্টা, গম, সরিষা, চিনি ও ডাল। ফলের মধ্যে রয়েছে আনারস, আপেল, কমলা, আঙ্গুর। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়লা, চুন, পেট্রোলিয়াম পণ্য, পাথর। আসামের আয়তন প্রায় ৭৯ হাজার বর্গকিলোমিটার। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, পাট, চিনি, তুলা, চা, রাবার, কফি। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কয়লা, চুন, পেট্রোলিয়াম পণ্য, লোহা ও পাথর। মনিপুরের আয়তন প্রায় ২৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান ফসল হচ্ছে ভুট্টা, তেল, সরিষা,ধান, চিনি, গম। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে চুনাপাথর ও ক্রোমেট। মেঘালয়ের আয়তন প্রায় ২৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান শস্য হচ্ছে ভুট্টা, ধান, পাট, রাবার ও কফি। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়লা, কাচ, চীনামাটি, আকরিক। মিজোরামের আয়তন প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রধান শস্য হচ্ছে ধান ও ভুট্টা। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়লা, চুনাপাথর ও গ্যাস। নাগাল্যান্ডের আয়তন ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখানেও রয়েছে ধান, ভুট্টা, পাট, চিনি, কলা, আনারস, আদা, হলুদসহ বিভিন্ন পণ্যের সমাহার। রয়েছে চুনাপাথর, কয়লাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ। ত্রিপুরাতেও রয়েছে ধান, চিনি, কলা, কমলাসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদ।
ভারতের সঙ্গে সীমানা : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা প্রায় ৪০৯৬ কিলোমিটার। এ সীমারেখার মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় চার রাজ্যের সঙ্গে ১৮৮০ কিলোমিটার। রাজ্যগুলো হলো আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম। উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর আন্তর্জাতিক সীমারেখার ৩৭ ভাগই বাংলাদেশের সঙ্গে। আসামের সঙ্গে ২৬৩ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সঙ্গে ৪৪৩ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সঙ্গে ৮৫৬ কিলোমিটার এবং মিজোরামের সঙ্গে ৩১৮ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ সীমানা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে এসব রাজ্যের সম্পর্কের উন্নতি আশানুরূপ হয়নি। চট্টগ্রাম চেম্বার সূত্র জানায়, এসব রাজ্যের সঙ্গে সংশ্লি¬ষ্ট ৩৩টি সীমানা পথ বা স্থলবন্দরের মধ্যে ১৭টি চালু রয়েছে, বাকি ১৬টি নিষ্ক্রিয়। মেঘালয় সীমানার ১১টি স্থলবন্দরের মধ্যে ৮টি সক্রিয়। এগুলো হলো ডাউকি-তামাবিল, ভোলাগঞ্জ-ছাতক, বোরসোরা-চেরারগঞ্জ, সেল¬াবাজার-ছাতক, বাঘমারা-বিজয়পুর, ডলু-নাকুগন, গাছুয়াপাড়া-করইতলি, মেহেন্দ্রগঞ্জ-ধনুয়া। ত্রিপুরা সীমানার ৮টি স্থল বন্দরের মধ্যে ৫টি সক্রিয়। এগুলো হলো আগরতলা-আখাউড়া, শ্রীমন্তপুর-বিবিরবাজার, রাগনাবাজার-বাথুলি, খোইয়াঘাট-বাল¬া, মনুঘাট-চাতলাপুর। আসামের সীমানার মধ্যে থাকা ১৩ স্থল বন্দরের মধ্যে ৪টি চালু রয়েছে। এগুলো হলো করিমগঞ্জ-জকিগঞ্জ, সুতারকান্দি-শেউলা, মনকাচর-রৌমারী, গোলকগঞ্জ-ভূরুঙ্গামারী। মিজোরামের সীমানার সঙ্গে থাকা দেমাগ্রি স্থলবন্দরটি নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধ থাকা অনেক স্থল বন্দর পুনরায় চালুর ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে। আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগ, সাবরুম-রামগড় ও দেমাগ্রি-তেগামুখ স্থল বন্দর পুরোদমে চালুর ব্যাপারে উভয় সরকারের মাঝে চুক্তি হয়েছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বিদেশ থেকে যেসব পণ্য চড়া দামে আমদানি করে তার মধ্যে অনেক পণ্য স্বল্প মূল্য ভারতের সেভেনসিস্টার হতে আমদানি করতে পারে। বিশেষ করে খনিজ সম্পদে ভরপুর ভারতের সেভেনসিস্টার রাজ্যগুলো। খনিজ সম্পদের বেশির ভাগ আমদানিই হচ্ছে বিদেশ থেকে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে নানা মতের পার্থক্যের কারণে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া সুযোগ গ্রহণ করতে এরই মধ্যে ভারতের সব মহলে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। এত দিন ধরে উদ্যোগের অভাবের কারণে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সেভেনসিস্টার রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়নি। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ট্রানজিটসহ বিভিন্ন চুক্তির পর ব্যবসায়ীরা মনে করছেন সামনে ইতিবাচক অনেক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।