আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো কান। কানের বিভিন্ন সমস্যায় ছোট-বড় অনেকেই ভোগেন। কানে ব্যথা, চুলকানি, পানি ঢুকে যন্ত্রণা, শোঁ শোঁ শব্দ করা কিংবা সংক্রমণের মতো সমস্যা দেখা যায়। কান দিয়ে পুঁজ/পানি পড়া সাধারণত মধ্যকর্ণের রোগ। কান পাকা যেহেতু মধ্যকর্ণের সংক্রমণ, তাই এতে কানের পর্দা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে অনেক সময় বহিঃকর্ণের কিছু প্রদাহের কারণেও কানে পুঁজ/পানি হতে পারে। এই কান দিয়ে পুঁজ/পানি পড়া খুবই অপ্রীতিকর এবং যে কোনো বয়সে দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রধানত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
কান পাকা রোগ কেন হয়
* আমাদের সবারই ইউস্টেশিয়ান টিউব নামক একটা টিউব আছে, যার এক মাথা থাকে মধ্যকর্ণে এবং আরেক মাথা থাকে নাকের পেছনে ন্যাজোফেরিংস নামক স্থানে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এ টিউবটা থাকে খাটো, প্রশস্ত এবং একদম সোজাসুজি। তাই মায়েরা শিশুদের বুকের দুধ অথবা বোতলের দুধ/তরল মাথার দিকটা একটু উঁচু না করে ফ্লাট/কাত অবস্থায় খাওয়ালে তখন এই দুধ/তরল কিছুটা হলেও মধ্যকর্ণে চলে যায় এই টিউব দিয়ে। পরবর্তীতে যা থেকে মধ্যকর্ণে ইনফেকশন হয়ে কান পাকা রোগ সৃষ্টি হয়।
* যেসব বাচ্চার ঘন ঘন ঠান্ডা লাগে, আপার রেসপিরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশন বেশি হয়, টনসিলে ইনফেকশন হয়, ঘন ঘন সর্দি থেকে সাইনোসাইটিস হয়, এডিনয়েড বেশি থাকে, তাদের ক্ষেত্রে ইউস্টেশিয়ান টিউবের নরমাল কর্মক্ষমতা কমে গিয়ে টিউবের কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। এসব কারণে প্রথম দিকে হঠাৎ করে কানে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়, জ্বর থাকে, এরপর কানের পর্দা ফুটো হয়ে পানি বেরিয়ে আসে। ওই সময় ঠিকমতো এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেলে পর্দার ছিদ্রটি স্থায়ী হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে কানে ইনফেকশন হওয়ার কারণে কান দিয়ে পানি/পুঁজ আসে। বড়দের ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন ভুগলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
* কানে আঘাতজনিত কারণে পর্দা ছিদ্র হয়ে গেলে এবং এর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না করানো হলে পরবর্তীতে ঠান্ডাজনিত কারণে সর্দি, কাশি, গলাব্যথা হলে কানের পর্দা দুর্বল হয়ে কান দিয়ে পুঁজ/পানি আসতে পারে।
লক্ষণ :
* কান দিয়ে পুঁজ বের হওয়া। এই তরল দুর্গন্ধযুক্ত বা দুর্গন্ধহীন হতে পারে। অনেক সময় পুঁজ রক্তমিশ্রিত থাকতে পারে। কান পাকা রোগের মধ্যে একটি ধরন আছে, যেখানে কান কিছুদিন শুকনা থাকে আবার কিছুদিন পরপর ভেজা থাকে অর্থাৎ পানি বা পুঁজ বের হয়। আবার আরেক ধরনের কান পাকা রোগ আছে, যেখানে কান কখনোই শুকায় না।
* কানে কম শোনা ও বন্ধ বন্ধ অনুভূতি লাগা, এমনকি সারাক্ষণ অস্বস্তি বোধ হওয়া।
* কানে বা মাথার ভেতরে শো শো শব্দ হওয়া, মাথা ঘুরানো, ভারসাম্য নষ্ট হওয়া।
* হঠাৎ প্রদাহের ফলে অনেকের কানে তীব্র ব্যথাসহ জ্বর আসতে পারে।
চিকিৎসা :
কানের পর্দা ছিদ্র হয়ে প্রচুর পরিমাণে পুঁজ পড়াসহ কান পাকার অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে সিস্টেমিক অ্যান্টিবায়োটিক, কানের অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ, বয়সভেদে নাকের ড্রপ এবং অ্যান্টিহিসটামিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি অবশ্য পালনীয় কিছু নিয়ম মেনে চলতে বলা হয়; যেমন-ডুব দিয়ে গোসল না করা, সাঁতার না কাটা। গোসলের সময় ইয়ারপ্লাগ অথবা নারিকেল তেলে ভেজা তুলা কানে দিয়ে গোসল করা। ঠান্ডা পরিহার করা, ফ্রিজের পানি, আইসক্রিম না খাওয়া, অযথা কান পরিষ্কার না করা, কানের ভেতর মোরগের পাখনা, কচুর ডগা, ম্যাচের কাঠি, কলমের মুখ ইত্যাদি ঢুকিয়ে পরিষ্কার করা সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়। এ পরামর্শ দ্বারা দুই সপ্তাহের মধ্যে বেশিরভাগ রোগীর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেইসঙ্গে কানের পর্দার ছিদ্রও বন্ধ হয়ে যায়। যদি পর্দার ছিদ্রটা বড় হয় এবং বারবার পুঁজ পড়ে, তাহলে কিন্তু ওষুধে কাজ হয় না অনেক সময়। যদি ৬ মাসের মধ্যে কানের পর্দা জোড়া না লাগে, কানে কম শোনে, তাহলে একটা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাইক্রোসার্জারি করে পর্দা জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়। তবে সেক্ষেত্রে কান শুকনো থাকতে হবে।
তবে মারাত্মক ধরনের কান পাকা রোগে অপারেশনই হচ্ছে প্রকৃত চিকিৎসা। অনেক ক্ষেত্রে রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য মারাত্মক ধরনের কান পাকা রোগের অপারেশন করতে হয়। এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান নামক রেডিওলোজি পরীক্ষার বিশাল গুরুত্ব রয়েছে।
কানের ইনফেকশন হলে প্রথম দিকে যদি চিকিৎসা করানো হয়, তাহলে কান পাকা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু কানের ভেতর কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা না জেনে যদি কেউ চিকিৎসা করে, তাহলে সেটার ফল ভালো হবে না। তাই এ নিয়ে সচেতন থাকাটা জরুরী।
লেখক : নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জন, রেজিস্ট্রার, নাক-কান-গলা বিভাগ; সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট।
Leave a Reply