আই সি ইউ এর সাথে আমার বন্ধন আত্তার বন্ধন। ২০০৭ সালে ইন্টার্নশিপ শেষ করেই মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে শুরু করেছি। তারপর সিনিয়র হাউজ অফিসার>রেজিস্ট্রার>সিনিয়র রেজিস্ট্রার >স্পেসালিষ্ট> এসোসিয়েট কনসালটেন্টের সব ধাপ পেরিয়ে আজ ফুল টাইম আই সি ইউ কনসালটেন্ট, তাও প্রায় চার বছর হতে চললো। চাকুরির পাশাপাশি ঢাকার সব স্বনামধন্য হাসপাতালে দীর্ঘ ৯ বছর অনারারি ট্রেনিং করেছি এনাস্থেসিয়া আর আই সি ইউ তে। মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় সম্পন্ন করেছি ডিপ্লোমা, এফ সি পি এস, এবং এম ডি নামক পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী। ভুমিকাটা লম্বা করলাম নিজেকে জাহির করার জন্য নয়, বরং গত দেড় বছরের ভয়াবাহ অভিজ্ঞতার সামান্য কিছু শেয়ার করার জন্য।
এই ১৪ বছরের আই সি ইউ ক্যারিয়ারে কতশত মৃত্যু দেখেছি, কত রোগীর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে চু ভিজিয়েছি, কত রোগীর মৃত্যুতে রোগীর স্বজনকে কাউন্সিলিং করেছি তার হিসাব রাখিনি কখনো। কত রোগীর আপন জনকে শেষ বিদায়ের সময় রোগীর বিছেনার পাশে বসতে দিয়েছি, প্রিয়জনের হাতটা ধরতে দিয়েছি, স্পিরিচুয়াল সাপোর্ট দিয়েছি রোগী এবং তার প্রিয়জনের ইচ্ছা অনুযায়ী যতটুকু করা সম্ভব তার সবটুকুই।কিন্তু কোভিড কালীন এই সময়ের প্রতিটা মৃত্যুই অন্যরকম টাচি। আপনি চিন্তা করুন আপনার আপনজনকে কোভিড আই সি ইউ তে ভর্তি করানোর পর যদি সুস্থ হয়ে ফেরত যান তবেই তাকে আবার দেখতে পারবেন, আর যদি সুস্থ না হন তবে আর কখনোই দেখতে পাবেন না। আপনি অনুমানও করতে পারবেন না যখন একজন রোগীর অক্সিজেন ডিমান্ড আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তখন তার মনের ভেতর কি অবস্থা চলতে থাকে। এ যেন ফাসির দন্ড প্রাপ্ত আসামির অনিশ্চিত অপো, এই বুঝি ডাক এলো ফাসির মঞ্চে নেয়ার।একটা রোগীকে হয়তোবা ফেস মাস্ক দিয়ে অক্সিজেন দেয়া শুরু করলাম, তারপর হাই ফো ন্যাযাল ক্যানুলায় অল্প পরিমান অক্সিজেন দিয়ে শুরু করতে হলো, রোগীর অক্সিজেন ডিমান্ড আরো বাড়তে থাকলো দিনকে দিন, আরো বেশি বেশি পারসেন্টেজ অক্সিজেন দিতে থাকলাম, একটা সময় হাই ফো ন্যাজাল ক্যানুলা আর নন ইন ভ্যাসিভ ভেন্টিলেশনে সর্বোচ্চ অক্সিজেন দেয়া শুরু করলাম।একটা গ্রুপ রোগী এই অবস্থা থেকেও ফেরত আসতেছেন, আর যে গ্রুপ এখানেও রেস্পন্স করছেন না তার জন্য কি? হয়ত নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপো নয়তো লাইফ সাপোর্টে দেবার পালা, কিন্তু তারপর, হ্যাঁ এবার আর আমাদের হাতে কিছুই নাই।
আপনার রোগী কিন্তু ফুললি কনসাস অরিয়েন্টেড, তিনি সব বুঝতে পারছেন, তার প্রতিটা শ্বাষ অনেক কষ্টের, আমরা সেই কষ্টকে লাঘব করার চেষ্টা করি এই অক্সিজেন দিয়েই।লাইফ সাপোর্টে দেয়ার আগ প্রয্যন্ত তিনি সব বুঝতে পারছেন এবং এটাও বুঝতে পারতেছেন লাইফ সাপোর্ট থেকে তার ফেরার সম্ভাবনা কতটুকু। আমরা অসহায় ভাবে অপো করতে থাকি শেষ সময়ের জন্য। আপনি কি জানেন সেই অপোটা কত হৃদয়বিদারক, কতটা বেদনাদায়ক সেই রোগী আর তার স্বজনদের জন্য।এবার আসুন আপনার হাতে যদি পর্যাপ্ত পরিমান অক্সিজেন না থাকে তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে। আপনি কি জানেন অক্সিজেন ছাড়া অক্সিজেন ডিপেনডেন্ট কোভিড রোগীর একেকটি শ্বাষ কতটা কষ্টকর। মাছকে যখন পানি থেকে উঠিয়ে মাটিতে রাখা হয়, তখন মাছ যে ভাবে ছটফট করে কষ্ট পায়, ঠিক তেমনিভাবে অক্সিজেন ডিপেন্ডেন্ট কোভিড রোগীরা অক্সিজেন ছাড়া কষ্ট পান, তার প্রতিটি শ্বাষ ততটাই কষ্টকর আর অসহায় যেমনটি হয় কোনো জলচর প্রাণীকে স্থলে রাখলে। আপনি কি জানেন একটি সিলিন্ডারে কত লিটার অক্সিজেন থাকে? মাঝারি সাইজের একেকটি সিলিন্ডারে থাকে প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ লিটার। প্রতি মিনিটে যদি ৫ লিটার অক্সিজেন কাউকে দেয়া হয় তবে ঘন্টায় লাগবে ৩০০ লিটার।
অতএব ১ সিলিন্ডারে চলবে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা। আর মিনিটে ৪ – ৫ লিটার অক্সিজেন সাপোর্ট লাগা কোভিড রোগীর অক্সিজেন সাপোর্টের প্রাথমিক অবস্থা। সময় যত গড়াবে অধিকাংশ েেত্রই রোগীর অক্সিজেন সাপোর্টের পরিমান আরো বাড়াতে হবে।অতএব, একটা দুইটা সিলিন্ডার দিয়ে তীব্র সংক্রমণ যুক্ত কোভিড রোগীকে বাচানো সম্ভব নয়, আপনি হয়ত কিছুটা সময় পেতে পারেন রোগীকে ট্রান্সফার করার জন্য বা প্রাথমিক পর্যায়ের সাপোর্ট দেয়ার জন্য। কিন্তু চিকিৎসার জন্য দরকার নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ। যা শুধুমাত্র হাস্পাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ সিস্টেমের মাধ্যমেই সম্ভব। আজ ভারতের বিভিন্ন হাস্পাতালের ভেতরে আর ইমারজেন্সিতে রোগীরা যেভাবে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন তা মানবতার জন্য লজ্জাজনক, বিবেকসম্পন্ন মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। আজ অনেককেই দেখলাম ভারত যখন বাংলাদেশে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করেছে তখন গলা ফাটিয়ে চিতকার করছেন। আচ্ছা ভাই আপনি যদি বাংলাদেশের নাগরিক না হয়ে ভারতের নাগরিক হতেন, তখন কি এই অবস্থায় অক্সিজেন রপ্তানি করতে দিতেন। না দিতেন না, আপনি বর্ডারে গিয়ে অক্সিজেনের লড়ি ছিনতাই করতেন নিশ্চিত। কই আপনিতো এই প্রশ্ন অপনার অথিরিটিকে করছেন না যে, আপনাকে কেনো এখনো আমদানি নির্ভর অক্সিজেনে বাচতে হবে? আপনার কেছ সিনারিও যদি ভারতের মত হয়, তবে আপনার অথরিটির প্রস্তুতি কি? আপনার নীতি নির্ধারনী মহল কি প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাননি বা পাচ্ছেন না? আপনার কয়টা হাসপাতালে সেন্ট্রাল পাইপলাইন অক্সিজেন সরবরাহ সিস্টেম আছে? ডাক্তার সাহেব অক্সিজেন পাইপ লাইনে অক্সিজেনের প্রেশার ঠিকমতো পাচ্ছেন তো? আপনি কি এই প্রশ্ন গুলো করার সাহস রাখেন? আমার নাইটমেয়ারের শুরু এখান থেকে।একটা সময় জানতাম আমার নার্ভ অনেক শক্ত, অনেক কঠিন সময়কে হজম করেছি নির্বিকার ভাবে, অনেকবার শিড়দাড়া সোজা করে দাঁড়িয়েছি জীবনের শত ধ্বংশস্তুপের ভেতর থেকেও।
গত দেড় বছর ধরে যা ফেছ করছি তাতে সেই শক্তি আর উদ্দমে ভাটা পরেছে অনেকটাই। আজ শুধু চোখের সামনে ভেসে আসে সেই রোগী গুলোর মুখ যাদের ফুসফুস কে ছিন্নভিন্ন করেছে করোনা ভাইরাস আর তিলে তিলে ঠেলে দিয়েছে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে, চোখের সামনে দেখেছি করুন চাহুনি, ওভার ফোনে স্বজনের আর্তনাদ। আমার হাতে এখনো অনুভব করি ত্রিশ সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট মেয়েটার পেটের ভেতরে বাচ্চাটার মুভমেন্ট। মেয়েটা সবসময় ওর পেটের উপর হাতটা রাখত আর বাচ্চাটার মুভমেন্ট মনিটরিং করতো। এ যেন অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের হাত থেকে গর্ভের বাচ্চাকে রা করার প্রানন্তকর প্রচেষ্টা। আহারে হতভাগা মেয়েটা। বেহেশতে গিয়ে নিশ্চয়ই তুমি তোমার বেবীকে পাবে, এই দোয়াই করি……আমি ভুলতে পারিনা ৪২ বছরের সেই রোগীটার আকুলতা – ” স্যার আপনি যদি আমায় আপনার হাতটা ধরে রাখার অনুমতি দেন শেষ সময় প্রয্যন্ত, তবেই আমি আমাকে লাইফ সাপোর্টএ দেবার অনুমতি দিব”……।আমার কানে এখনো ভেসে আসে হাই ডিপেডেন্সি ওয়ার্ডের পাশাপাশি তিন বিছানায় শুয়ে থাকা মা-বাবা আর তাদের ছেলের মধ্যকার কথোপকথন, কি আসহায়, কি নিদারুন কষ্টে ভরা সেই আলাপন। তাদের একজনকে যখন আই সি ইউ তে শিফট করা হলো লাইফ সাপোর্ট দেয়ার জন্য, বাকি দুই জনের সেই অসহায় মুহূর্তের মায়াবী চাহনি বলে দিচ্ছিল পুরো এক জীবনের গল্প…..আমি ভুলতে পারিনা সেই ভদ্রমহিলার কথা যার স্বামী ভর্তি ছিলেন পাশের আই সি ইউ তেই, রাউন্ডের সময় সেই ভদ্রমহিলার কাছে গেলেই খবর নিতেন তার প্রিয়মুখটি কেমন আছেন।
আমিও যতটুকু তাকে জানানো উচিৎ ঠিক ততটুকুই তাকে জানাতাম, এরপর একদিন উনি আর জানতে চাইলেন না উনার একান্ত আপনমানুষটি কেমন আছেন। আমারও আর জানানোর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না যে! আচ্ছা ভদ্রমহিলা কি ভাবে জানলেন সেইদিন সকালেই তার প্রিয়মুখ তাকে রেখে অনেক দূরে চলে গেছেন! সচেতন ভাবেই আমার কোন স্টাফই তাকে কোন কিছুই বুঝতে দেননি। ওইদিনের পর থেকে উনার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে লাম্বা রাউন্ড দিতে পারতাম না, উনিও আর কিছুই জিজ্ঞেস করতেন না। আচ্ছা উনি কি উনার শত কষ্টের মধ্যেও আমার ফেস শিল্ড আর মোটা কাচের চশমার আড়ালে থাকা চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিলেন…….আমি এখনো গন্ধ পাই সেই ছোট্ট তোয়ালেটার, যে ব্যাবহৃত তোয়ালেটা ছিল ৯ মাস বয়স্ক এক বেবীর আর যেটা হাতে করে হাসপাতালে এসেছিলেন এবং শেষ প্রয্যন্ত বুকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন ৪৬ বছর বয়স্ক কোভিড পজিটিভ এক হতভাগ্য বাবা……গত দেড় বছরে আমার দেখা প্রতিটা মৃত্যুই একেকটা ট্রাজিক মহাকাব্য। শত শত সাফল্যের গল্পও আছে, কিন্তু সেগুলো তো আর আমাকে ঘুমাপাড়ানির গান শুনিয়ে শান্তিতে ঘুম পাড়িয়ে দেয় না, বরং ওই মৃত্যু গুলোই উপস্থিত হয় আমার কান্তিতে। আমার সুহৃদ, আমার শুভাকাঙ্ী, যে আমার এই পোস্টটি পড়লেন, কি বলতে পারি আপনাকে ? একান্ত পেটের দায়ে না হলে বাহিরে বের হইয়েন না, বাহিরে যদি বের হতেই হয়, তবে জামা জুতো পরার আগে মাস্ক পরুন। ভীর ভাট্টা এড়িয়ে চলুন। মনে রাখবেন, মাহামারি থেকে একা বাঁচার কোন সুযোগ নাই, বাঁচতে হলে সবাইকে একসাথে বাঁচতে হবে, আর মরতে চাইলে গনমৃত্যু অবধারিত। সিদ্ধান্ত আপনার। আমরা ফ্রন্ট-লাইনার রা অলরেডি কান্ত, মহা কান্ত। শরীর অবসাদগ্রস্ত, মন বিষাদময়। আরো লম্বা সময় ধরে ফাইট করার আর মৃত্যুর মিছিল দেখার মত মন-মানসিকতায় আর আমরা নাই। আপনাদের সামান্য অবহেলায় আমাদের এই অনিশ্চিত যাত্রা আরো দীর্ঘ হোক তা আর কোনভাবেই কাম্য নয়। মহামান্য নীতি নির্ধারনী কর্তা ব্যাক্তিরা,পাপ অনেক হয়েছে এবার থামুন, এখনো সময় আছে, সব হাস্পাতালে পর্যাপ্ত সেন্ট্রাল পাইপ লাইন অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যাবস্থাটা অন্তত করুন।
আল্লাহ মাফ করুন, ভারতীয় ঠেউ যদি আমাদের এখানে আসে তবে কিন্তু কেউই রা পাবেন না। মনে রাখবেন কোন ভি আই পি, সি আই পি ব্যাবস্থাই আপনাকে সুরা দিতে পারবে না। গত দেড় বছর যাবত কিন্তু ব্যাংকক আর সিংগাপুরের এয়ার এম্বুলেন্স সার্ভিসও বন্ধ। দোয়া করি বিশ্ব মানব সন্তানের জন্য, অন্তত অক্সিজেনের অভাবে আপনজনের সামনে কষ্ট করে তিলেতিলে মৃত্যু যেন না হয় কোন মানবের। আল্লাহ তুমি কবুল করো এই ফরিয়াদ। আমিন সুম্মা আমিন।
সবিনয়ে –
ডাঃ মোঃ জাফর ইকবাল
ডি এ, এফ সি পি এস ( এনাস্থেসিয়া)
এম ডি ( ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন)
কন্সালটেন্ট- আই সি ইউ
এভার কেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা।
আর এম সি – ৪১ তম প্রজন্ম
(ডাক্তার ইসমিতা জাহান ইমুর থেকে সংগ্রহিত )
Leave a Reply