আমরা বাঙালী, শোষণ, অন্যায়, চাপিয়ে দেওয়া শাসকের শত শত বছরের অন্যায্য নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজরোপণ করতে চাই। তোমাদের চাপিয়ে দেওয়া, মনগড়া ভাষার পিষ্ঠে, রক্ত দিয়ে লিখে দিব এটা আমার মায়ের ভাষা নয়, এটা বিজাতীয় ভাষা। বাংলা ভাষা শুধু সমৃদ্ধশালী নয়, বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণও বটে। বাংলা ভাষার ভাষানীতি আছে শুধু কাগজে কলমে। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও, দিনে দিনে ভাষার অসম্মানের পরিধি ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাষাকে অসম্মানি করা আর ভাষা সৈনিকদের রক্তের সাথে বেঈমানী করা, শাব্দিক অর্থে কোনো পার্থক্য নাই।
বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রমাণ করার জন্য হাজার বছরের সাধনা অন্তর্নিহিত ছিল, বাঙালী ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের। যুগের তালে তাঁরা বৈচিত্র্যময় লিখনপদ্ধতি ও রচনাবলী উপহার দিয়েছেন। বাংলা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০ তম অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
বর্তমানে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করে। বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালীদের অসীম ভালবাসা আর সালাম, রফিক, রবকত সহ অজানা ভাষা শহীদদের রক্তের প্রতিদান স্বরূপ বিশ্ববাসী বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
আমরা শুধু বাংলা ভাষার সর্বস্তরে প্রযোগে অবহেলা দেখাচ্ছি তা নয়। ভাষা শহীদদের স্মৃতিসৌধগুলো সারা বছর অরক্ষিত ও অবহেলার ঘানী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাষা শহীদদের আত্মা হয়তোবা অভিশাপ দিচ্ছে জাতি এবং রাষ্ট্রের ভাষানীতি প্রযোগকারী সংস্থা সমূহকে। একুশ ফেব্রুয়ারি আসলে একটু চুনকালি করে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করেন।
আমাদের মায়ের ভাষা এখন বিশ্বময় সমাদৃত। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলনের আইন প্রণয়ন করা হয়। পরিতাপের বিষয়, ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পরও দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না! এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতার চেয়েও বড় কিছু মনে করি। রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম ভাগে ৪ নাম্বার অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ভাষা “বাংলা” স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রযোগের স্বীকৃতি দিতে হবে মাঠ পর্যায়ে। সংবিধানে থাকলে হবেনা, স্বদেশী ভাষা বাঙালীদের স্বভাবে থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬ সালের ছয় দফা বাঙালী জাতির রক্তে প্রতিবাদের বীজরোপণ করেছিল। জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে শোষণকারীর কন্ঠকে চেপে ধরা সম্ভব, তা ছয়দফা আন্দোলনে জাতি বুঝতে পেরেছিল। আমি মনে করি স্বাধীনতার জন্য প্রথম বীজরোপন হয় ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলনে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার অর্জনে একটা ধনাত্মক বার্তা পায় জাতি। জাতি পরিস্কার বুঝতে পারে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি বৃথা যায়নি। আমরা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিলে, সে রক্তও বৃথা যাবেনা।
বাংলার ভাষা প্রেমিকদের রক্তে রন্জিত মায়ের ভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। দেশে নিজের ভাষা এতো সমৃদ্ধশালী হওয়া সত্বেও বিজাতি ভাষার দৌরাত্ম্যে বাংলা ভাষা এখন স্বদেশে পরবাসী! আকাশ সংস্কৃতির বেসামাল আগ্রাসনে বাংলা ভাষা তার কাঙ্খিত সম্মানটুকু পাচ্ছেনা। দেশের যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে (যেমন- বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন, ইত্যাদি) বিজাতীয় ভাষা ব্যবহার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আদালতের রায় আছে, আইন আছে কিন্তু সরকারী, আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান, বাড়ী, রোডের নাম দেখলে মনে হবে ইংরেজী আমাদের বাংলা ভাষার সতীন।
৫ টাকার একটা চানাচুরের প্যাকেটেও বিজাতীয় ভাষা লেখা থাকে! নিম্ন আদালতে বাংলায় রায় দিবে কিন্তু উচ্চ আদালতে বাংলায় রায়ে অনীহা! বাংলা ভাষা আজ সমন্বয়হীনতার যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। হিন্দি আর ইংরেজী ভাষার দৌরাত্ম্য ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। বিপিএল এর মতো আন্তর্জাতিক খেলায় যদি হিন্দি ভাষার ধারাভাষ্য সম্প্রচার করা হয়, তাহলে বাংলা ভাষার দুর্দিন যাবে কিভাবে? এফএম রেডিও, কমিউনিটি রেডিও লোকজন বাংলা ভাষাকে বিবস্ত্র দিচ্ছে। বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ জাতি যদি শিখতে চায়, এফএম রেডিও আর ব্যান্ডের গানের ধারাভাষ্য শুনলেই হবে।
বাংলা ভাষা যুগের তালে তাল মিলিয়ে পথ চলতে শিখেছে। তাহলে কেন মোবাইলে, বিভিন্ন অ্যাপস এ শতভাগ বাংলা ব্যবহৃত হচ্ছে না? ভাষার আঞ্চলিক রূপ যেমন আছে, তেমনি প্রমিত রূপ আছে। দুটিই আমাদের ভাষা। কেন বাড়ীর নাম, গাড়ির নাম্বার, দোকানের নাম, বাংলায় লিখতে বলতে হবে? সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্র বাংলায় করতে কেন বলতে হবে? তাহলে আপনার আমার স্বাধীনতার আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায়? তাই কবি আব্দুল হাকিম সপ্তদশ শতকে লিখেছেন, “যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
রাষ্ট্র যদি গণতন্ত্রের উন্নতি চায়, দেশের উন্নতি চায়, দেশের সোনার বাংলা স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিয়ে চায়, তাহলে দেশের ১৭ কোটি মানুষকে নিয়ে উন্নতি করতে হবে। তাহলে বাংলা ভাষা লাগবে। ভাষা শহীদদের রক্তে বিধৌত বাংলা ভাষা।শহীদদের রক্তের দাবি, তাঁদের আত্বত্যাগের দাবি সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার অযৌক্তিক দাবি নয়।
ভাষার সর্বস্তরে প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন ও জনসচেতনতা ভাষার প্রযোগ বৃদ্ধি করবে। আমরা যদি পুরাপুরি বাঙালী হতে পারি, তাহলেই স্বদেশী ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভাষাপ্রীতির মাধ্যমে দেশপ্রেম প্রকাশ পায়।
Leave a Reply