বছর তিনেক আগে প্রিয় বাবার হাত ধরে কলেজে এসেছিলেন সানিয়া সুলতানা। বাবার ছোট মেয়ে হওয়ায় খুব আদর করে ডাকতেন ‘স্বর্ণা’। সেই স্বর্ণাই শনিবার ক্যাম্পাস থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। এবার আর বাবার হাত ধরে নয়, নিথর দেহে সাইরেন বাজিয়ে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, সহপাঠী, অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে বিদায় জানান প্রিয় শিক্ষাঙ্গনকে।
দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে শুক্রবার দিবাগত রাত সোয়া ৩টায় সাদিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বছর দুয়েক ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন। প্রবল ইচ্ছে ছিল ক্যাম্পাসে ফেরার। দু’দফায় চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু দুর্বল শরীর সায় দেয়নি। অবশেষে এসেছেন, কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সে কফিন বন্দি হয়ে। তবে ক্যাম্পাসে প্রাণোচ্ছ্বল থাকা সাদিয়া সঙ্গে পেয়েছেন অসংখ্য বন্ধুবান্ধবের ভালোবাসা আর নিখাদ আন্তরিকতা।
সাদিয়াকে বাঁচাতে কলেজের সহপাঠী বন্ধুরা কি প্রাণপণ চেষ্টাই না করেছিল। সবাই মিলে ‘অর্থিক ফান্ড’ খুলেছিল তিতুমীর কলেজের সকল স্বেচ্ছাসেবী ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। পাশাপাশি কলেজের সব শিক্ষক সহযোগিতা করেছে সাধ্যমত। সহপাঠীরা ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে সপ্তাহব্যাপী অর্থ সংগ্রহ করে। আয়োজন করে ‘কনসার্ট ফর সাদিয়া, ডিবেট ফর সাদিয়া’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বাকি ৬ কলেজের শিক্ষার্থীরাও আলাদা অর্থ সংগ্রহ করে নানাভাবে। কিন্তু প্রাণঘাতি ক্যানসার সহপাঠীদের অর্থ ও অকুণ্ঠ ভালবাসাকেও হার মানিয়েছে।
সাদিয়া সুলতানার খুব ইচ্ছে ছিল সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার। এ লক্ষ্যে তিতুমীর কলেজ সাংবাদিক সমিতির কর্মশালাতেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে স্বপ্নও স্বপ্নই থেকে গেল।
মারা যাওয়ার ঠিক ১২ ঘন্টা আগে শুক্রবার সাদিয়া তার নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন এভাবে, ‘হয়তোবা আমার সময় শেষ। আমি এখন কথাও বলতে পারছি না। আমাকে আমার ট্রিটমেন্টের জন্য যারা যেখান থেকে সাহায্য করেছেন, আমি তাদের কাছে থ্যাংকফুল। আর যারা আমাকে দেখতে চান, বাসায় এসে আমাকে দেখতে পারেন।’
সাদিয়ার শেষ ইচ্ছানুযায়ী তিতুমীর কলেজেই শনিবার বেলা ১১টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে কলেজের শিক্ষক ও হাজারো শিক্ষার্থী অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানান। পরে বাসার পাশে রাজধানীর বিমানবন্দরের কাওলা এলাকায় তার দাফন সম্পন্ন হয়।
মৃত্যুর আগে চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চেয়ে নানাভাবে আকুতি জানিয়েছিলেন সদা প্রাঞ্জল সাদিয়া। গত ১১ অক্টোবর তার সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসেও ছিল সেই আকুতি। তিনি লিখেছিলেন, ‘খুব শীঘ্রই হয়তো টাকার অভাবে আমিও মারা যাবো, আর তখন সবাই ঠিকই আমাকে দেখতে আসবে। কিন্তু সময় থাকতে খুব কম মানুষই সাহায্যের হাত বাড়াবে।’ সাদিয়ার ওই স্ট্যাটাসটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
২০১৮ সালে মে মাসে পরীক্ষার কেন্দ্রে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সাদিয়া। পরে তাকে প্রথমে উত্তরা মহিলা মেডিকেল ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন সেখানে চিকিৎসার পরেও অবস্থার অবনতি হলে উত্তরার আর এমসি হাসপাতালে জরুরি অপারেশন করা হয়।
অপারেশনে কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। মাঝে কিছুদিন ভালো ছিলও সাদিয়া। নিয়মিত নিজের ক্লাস ও টিউশনিও করেছে। কিন্তু ফের রমজানের আগে আবার ব্যথা শুরু হলে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান বিদ্যুতের তত্ত্বাবধানে আলোক হাসপাতালে বিশোর্ধ্ব সাদিয়ার চিকিৎসা চলছিল।
কয়েকদিন আগে সাদিয়ার মা কামরুন নাহার জানান, ৮টি কেমোথেরাপির পর আরও একটি অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে ক্যানসার সমস্ত পেটে ও জরায়ুতে ছড়িয়ে পড়ছে। এর মাঝে আমরা কলকাতার টাটা মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাই। কিন্তু চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় আবার দেশে চলে আসি। আমার মেয়েটা সব সময় মানুষের সেবায় কাজ করেছে। মানা করলেও অন্যকে রক্ত দিত।
কিছুদিন আগেও বন্ধুবান্ধব নিয়ে মরণব্যাধি ‘ক্যানসার সচেতনতা ও স্বেচ্ছায় রক্তদান’ কর্মসূচি করেছিলেন সাদিয়া সুলতানা। নিজেও একাধিকবার মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিয়েছেন স্বেচ্ছায় রক্তদানের বাঁধনের এই কর্মী।
Leave a Reply