এর আগে গত ১৩ জুলাই দানবাক্স খুলে ১ কোটি ১৪ লাখ ৪৭ হাজার ৪৫০ টাকা ছাড়াও পাওয়া যায় বিদেশি মুদ্রা, প্রায় ১ কেজি স্বর্ণ ও রুপার অলংকার। প্রতিবারই দানবাক্স খোলার সময় কমিটির দায়িত্বশীলদের উপস্থিতিতে টাকা গোনার কাজটি করেন ব্যাংক কর্মকর্তা, মসজিদ কমপ্লেক্স মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে মসজিদটি আরও দৃষ্টিনন্দন করতে পরিচালনা পরিষদের সহসভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবদুল্লাহ আল মাসউদের তত্ত্বাবধানে সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কমপ্লেক্স উন্নয়নের পাশাপাশি নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন তোরণ ও প্রাচীর। শৈল্পিক আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
শুক্রবার কথা হয় জুমার নামাজের সময় দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিপুলসংখ্যক লোকের সঙ্গে। জামালপুরের মেলান্দহ থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বী বিপুল বসাক জানান, কয়েক মাস আগে আমি খুব বিপদে পড়ে চারদিক অন্ধকার দেখছিলাম। পরে কিশোরগঞ্জ শহরের ভায়রাভাই কার্তিক বসাককে বললে তিনি আমাকে এ মসজিদে নিয়ে এসে মানত করান। কিছুদিনের মধ্যেই আমি সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত হই। আজ (শুক্রবার) তাই ভায়রাভাইকে নিয়ে আবার এখানে এসেছি মানতের কোরআন শরিফ এবং নগদ অর্থ দিতে। টাকার পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোটা অঙ্ক বলতে পারেন। আমি তা প্রকাশ করে পাপ করতে চাই না। কথা হয় নড়াইল জেলার নড়াগাঁতি উপজেলা থেকে মানত নিয়ে আসা ব্যবসায়ী হাবিবুল হোসেন-শিউলী বেগম দম্পতির সঙ্গে। তারাও মানত নিয়ে এসেছেন, তবে কিসের মানত জানতে চাইলে তারা বলতে রাজি হননি। মানত করতে আসা এরকম অসংখ্য ভক্তের দেখা পাওয়া যায় জুমার সময়।
প্রথমদিকে দান থেকে পাওয়া অর্থ নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ থাকলেও ১৯৭৯ সাল থেকে মসজিদ পরিচালনায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে। প্রতিবছর আয়-ব্যয়ের ওপর অডিটও করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মসজিদের তহবিলে রয়েছে ৩ কোটি টাকার এফডিআরসহ ১০ কোটি টাকা। অর্জিত আয় থেকে ব্যয় করা হচ্ছে হতদরিদ্র ১২০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে গঠিত হাফেজিয়া মাদ্রাসা পরিচালনায়। এ ছাড়া মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা ছাড়াও জটিল ব্যধিতে আক্রান্তদের সাহায্য করা এবং আশপাশের বিভিন্ন মাদ্রাসার উন্নয়নে আর্থিক সহায়তাও দেয়া হচ্ছে এ তহবিল থেকে। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ২৯ সদস্যের পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। ডিসি ছাড়াও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি), পত্রিকার সম্পাদক, গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি), সদর মডেল থানার ওসি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক, জেলা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে পরিচালনা পরিষদ গঠিত।
কথা হয় ডিসি সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থের একটি অংশ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দরিদ্র, অসহায়-দুস্থ ও এতিমদের চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সহায়তা করা ছাড়াও মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নে অনুদান দেয়া হয়। মসজিদ কমপ্লেক্সে নূরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসার ১২০ জন অসহায়, পিতৃ-মাতৃহীন এতিম শিক্ষার্থীর ভরণপোষণসহ যাবতীয় ব্যয়ও নির্বাহ করা হয়। এখানে রয়েছে একটি বিশেষ লাইব্রেরিও।
কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রবীণ রাজনীতিক এবং পাগলা মসজিদ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান জানান, এক সময় পাগলা মসজিদের এ বিপুল অর্থ লুটপাট হতো। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন এসডিও পরবর্তী সময়ে এখানকারই ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান পাগলা মসজিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ওয়াকফ করে প্রশাসন ও সুশীল সমাজের লোকদের দিয়ে ব্যবস্থাপক কমিটি গঠন করে দেন। এর পর থেকেই মসজিদের দানবাক্সে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত অর্থবছরেই ১৯৬ জন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তের চিকিৎসা এবং দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের পেছনে ১৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং ১০১টি মসজিদ-মাদ্রাসা উন্নয়নে ৪৭ লাখ ১৩ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।
জানা যায়, শহরের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের সন্তান দেওয়ান আয়েশা আক্তারের ওয়াকফ করে দেয়া ১০ শতাংশ জমির ওপর প্রথম পাগলা মসজিদ নির্মিত হয়। পরে জমির আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ৪ একর। মসজিদ কমপ্লেক্স ছাড়াও রয়েছে মাদ্রাসা এবং বিশাল একটি গোরস্থান। কথা হয় ওয়াকফ স্টেটের পরিদর্শক ও অডিটর জুবায়ের আহমেদের সঙ্গে। অডিটকারী জুবায়ের জানান, গত ৭ বছর আমি অডিট করছি। এ পর্যন্ত হিসাবে তেমন কোনো ত্রুটি পাইনি।
জনশ্রুতি আছে, এক আধ্যাত্মিক পাগল বা সাধকের বাস ছিল কিশোরগঞ্জ শহরের সংলগ্ন নরসুন্দা নদীর মাঝে জগে ওঠা উঁচু টিলার ওপর। সব ধর্মের লোকের যাতায়াত ছিল সেখানে। ওই পাগল বা সাধকের মৃত্যুর পর তার উপাসনালয়টিকে কামেল পাগল পীরের মসজিদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন এলাকাবাসী। কিশোরগঞ্জের প্রবীণ রাজনৈতিক কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান জানান ঈশা খাঁর ৬ষ্ঠ পুরুষ শহরের হয়বত নগরের জমিদার দেওয়ান হয়বত দাদ খানের ভ্রাতুষ্পুত্রই ছিলেন সেই কামেল পাগলা পীর। আর তার নাম ছিল দেওয়ান জিলকদ দাদ খান। তিনি সংসার ও শান-শওকত ত্যাগ করে নরসুন্দা নদীর মাঝপথের ছোট্ট ঘরে ধ্যানমগ্ন থাকতেন।
সূত্র : যুগান্তর
Leave a Reply