কিশোরগঞ্জে ‘কিশোর গ্যাং’ কালচারের তৎপরতা শুরু হয় ২০১৮ সালের শেষের দিকে। তখন কিশোর বয়সী সন্ত্রাসীরা হকিস্টিক, চাপাতি, রামদা, ছুরি-লাঠিসহ মহড়া দিয়ে এলাকায় এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বর্তমানে শহরের বিভিন্ন এলাকায় এ রকম অন্তত ৩০-৩৫টি গ্যাং আছে। প্রতিটি গ্যাং-এ ৫০ থেকে ৬০ জন করে সদস্য রয়েছে। সদস্যদের বেশির ভাগ কিশোরগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থী, বেকার ও শ্রমিক শ্রেণির কিশোর। তাদের কোনও কোনও গ্যাং প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় চলে। মাঝেমধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে গ্যাং সদস্যদের আটক করলেও বেশির ভাগই অধরা রয়ে গেছে।
এসব ‘কিশোর গ্যাং’ এরইমধ্যে কয়েকটি দুর্ধর্ষ ঘটনা ঘটিয়েছে। বড় বাজার-তেড়িপট্টি এলাকায় কলেজছাত্র রাজা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিল তারা। এরপর শহরের ঈশাখাঁ রোডে যুবলীগ নেতা ইউসুফ মনিকেও নৃশংসভাবে খুন করে তারা। পরবর্তী সময়ে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রবেশপথ এলাকায় কিশোর ব্যবসায়ী সাগরকে খুন করা হয়।
‘কিশোর গ্যাং’ ‘সাজ্জাদ বাহিনী’ সম্প্রতি সনাতন ধর্মালম্বীদের শারদীয় দুর্গাপূজার রাতে বত্রিশ এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করে। এ ঘটনার প্রতিবাদ করে শুভ সরকার (১৬), প্রসেনজিৎ ঘোষ (১৭) ও তনয় বর্মণ বিকাশ (১৭) নামে তিন কিশোর। এ নিয়ে সাজ্জাদ ও তার দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়। এর তিন দিন পর রাতে সাজ্জাদ ও তার দলের সদস্যরা প্রতিবাদ করা ওই তিন কিশোরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ ঘটনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) শহরের বত্রিশ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন তাতিপাড়া এলাকা থেকে সাজ্জাদসহ তার দলের ১১ সদস্যকে আটক করে। পরে আটকদের কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়।
সাজ্জাদ বাহিনীর আটক কিশোর অপরাধীরা হলো– কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কালিয়াকান্দা গ্রামের আব্দুল আউয়ালের ছেলে ‘সাজ্জাদ গ্রুপের’ প্রধান সাজ্জাদ (১৭), কটিয়াদী উপজেলার গচিহাটা এলাকার মো. মোজাম্মেল হকের ছেলে আব্দুলাহ আল নোমান (১৬), একই উপজেলার করগাঁও গ্রামের মো. আইয়ুব হাজীর ছেলে মো. জুয়েল (১৬), জেলা শহরের উকিলপাড়া এলাকার মো. বুলবুল আহম্মেদের ছেলে মো. সানি আহাম্মেদ (১৬), স্টেশন রোড এলাকার ফজলুল মতিন সিদ্দিকির ছেলে ফজলুল করিম আকাশ (১৯), খরমপট্টি এলাকার সমির বৈষ্ণবের ছেলে সৌমিত্র বৈষ্ণব (১৬), বত্রিশ এলাকার মো. সুলতানের ছেলে ফজলে রাব্বি বাধন (১৮), একই এলাকার মুনসুর আলমের ছেলে মো. আনোয়ারুল ইসলাম (১৮), জালাল উদ্দিনের ছেলে মো. ইয়াছিন ইসলাম (১৮), রাখাল দত্তের ছেলে হৃদয় দত্ত (১৬) ও মোফাজ্জল ইসলামের ছেলে মো. আদনান ইসলাম (১৬)।
এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ সফরে এসে একটি অনুষ্ঠানে ‘কিশোর গ্যাং’-এর তৎপরতা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘শিগগিরই এদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।’
এ বিষয়ে কিশোগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক সাইফুল হক মোল্লা দুলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরের স্কুল-কলেজ, লেকপাড় ও অলিগলিতে তারা আড্ডা দেয়। দেখে বোঝার উপায় নেই তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। কিন্তু, কিছু বলতে গেলেই তারা চাপাতি, রামদা ও দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে বের হয়ে হামলা চালায়। শহরের সভ্য ও সামাজিক মানুষরা আজ তাদের কাছে জিম্মি। ‘কিশোর গ্যাং’-এর প্রতিকারের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের দাবির পাশাপাশি সচেতন মহলকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রতিহত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অশোক ঘোষ বলেন, ‘‘কয়েক বছর ধরে কিশোরগঞ্জে ‘কিশোর গ্যাং’য়ের তৎপরতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। তাদের কারণে কয়েকজন কিশোর খুন হয়েছে। প্রায় দুই বছর আগে শহরের নগুয়া এলাকায় সন্ধ্যার পর তাদের একটি দল মুখে কালো কাপড় বেঁধে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই কুপিয়ে জখম করেছে। তখন তারা ১৮ জনকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেছিল। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে রাস্তার পথচারী নারীরাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। প্রশাসনের কাছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মায়া ভৌমিক বলেন, ‘তাদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত এবং মোবাইল ফোন, ব্যাগ ও চেইন ছিনতাই করছে তারা। এজন্য অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। স্কুল-কলেজ চলাকালে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ড্রেস পরা ছেলেদের গ্রুপ করে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।’
কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘২০১৮ সালের শেষের দিকে এ ধরনের প্রবণতা আমাদের চোখে পড়েছিল। তারপর আমরা একটা স্পেশাল টিম গঠন করি। এ নিয়ে লোকাল থানা এবং গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কাজ করছে। এ ব্যাপারে পুলিশ সব সময় সজাগ থাকায় পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। সন্ধ্যার পর যেসব ছেলে ঘোরাঘুরি করে, কোচিং বা প্রাইভেটের কথা বলে বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দেয়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অভিভাবকের হাতে তুলে দিয়েছি।আশা করছি, ধীরে ধীরে এর প্রবণতা কমবে।’
সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙেপড়াসহ খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবারে এখন আর সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয় না। এসব কারণে সমাজে মূল্যবোধের অভাবে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে কিশোররা এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।