দিঘিটির অবস্থান জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে। প্রাচীন আমলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ এই দিঘির নাম ‘নান্দাইল দিঘি’। দিঘিটি নন্দলাল নামের একজন রাজা ১৬১০ সালে খনন করান বলে কথিত আছে। তাঁর নামানুসারে এটি নান্দাইল দিঘি নামে পরিচিত। স্থানীয় প্রবীণদের ভাষ্য, প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘবে রানির ইচ্ছা অনুযায়ী, কয়েক হাজার শ্রমিক লাগিয়ে এক রাতে দিঘিটি খনন করান রাজা নন্দলাল।
২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির গ্রন্থমালা–জয়পুরহাট শিরোনামের বইয়ের ৯৪ নম্বর পৃষ্ঠায় নান্দাইল দিঘির বিশদ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে আবার ভিন্ন ইতিহাস। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত বইটিতে উল্লেখ রয়েছে, মৌর্য আমলে এলাকায় খরা দেখা দিত। মাঠ ফেটে যেত। কৃষিকাজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে জলকষ্টে থাকতেন প্রজারা। জনহিতার্থে সম্রাট নন্দ বা নন্দলাল বিশাল এই দিঘিটি খনন করেন।
স্থানীয় লোকজন বলেন, ৫০ বছর আগেও ঐতিহাসিক এই দিঘিটি ছিল ঘন ঝাউ-জঙ্গলে ঘেরা। দিঘির পাড়ে ছিল উঁচু উঁচু টিলা। শত প্রজাতির গাছগাছালিতে অবাধ বিচরণ ছিল বিরল পাখপাখালির। জঙ্গলে দেখা মিলত হিংস্র বন্য প্রাণীর। বিষধর নানান সাপের বিচরণও ছিল এখানে। তবে এখন টিলা ও গাছ কেটে দিঘির পাড়ে গড়ে উঠেছে লোকালয়, জনবসতি, স্কুল-কলেজসহ নানা স্থাপনা। দিঘির জলে এখনো দেখা মেলে শামখৈল, পাতি সরালি, পানকৌড়ি, গাঙচিল, বালিহাঁস, চখাচোখিসহ শীতকালীন নানা অতিথি পাখির।
সরকারি মালিকানার ঐতিহাসিক এ দিঘির দেখভাল করে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসন। আশির দশকের শুরুর দিকে সরকার এখানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। পর্যটন করপোরেশন দিঘির পাড়ে কার্যালয়ও স্থাপন করে। নিয়োগ দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় জনবল। কিন্ত সেই উদ্যোগ বেশি দূর এগোয়নি। এক সময় পর্যটন করপোরেশন তাদের কার্যালয় গুটিয়ে নেয়। প্রত্যাহার করে জনবলও। অরক্ষিত নান্দাইল দিঘির পাড়ের গাছগাছালি লোপাট হয়। নির্বিচার কেটে ফেলা হয় বড় বড় টিলা। বেদখল হয় দিঘির পাড়ের জায়গা। গড়ে ওঠে লোকালয়, বসতি ও স্কুল-কলেজ। বর্তমানে জেলা প্রশাসন থেকে লিজ নিয়ে দিঘিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
পর্যটক-দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নান্দাইল দিঘির বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ করেছে উপজেলা পরিষদ। দিঘিতে নির্মাণ করা হয়েছে শানবাঁধানো ঘাট। দিঘির পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা রাস্তা ও ওয়াকওয়ে। সৃজন করা হয়েছে গাছগাছালি। দিঘির স্বচ্ছ জলরাশির সৌন্দয৴ উপভোগের জন্য আছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। পিকনিক পার্টির জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বিশ্রামাগার কাম রেস্টহাউস। কালাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান বলেন, পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তাব পর্যটন করপোরেশনে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে।
কবি ও কথাসহিত্যিক বজলুল কবির বাহার নান্দাইল দিঘির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধতার কথা জানান। তবে প্রাচীন এই দীঘিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই, মানুষের অবাধ বিচরণে পাখি ও প্রাণিকুল হুমকির মুখে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী দীঘিটি পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি।
সূত্র: প্রথম আলো
Leave a Reply